জুরাসিক পার্ক – মাইকেল ক্রিকটন (বাংলা অনুবাদ; পর্ব ৫)
দু’জন কালো
শ্রমিক ববির দিকে একটা খোঁড়া দেহ বয়ে নিয়ে আসছিল, একজন সাদা
লোক ওদেরকে চিৎকার করে করে নির্দেশ দিচ্ছিল। সাদা লোকটার লালচুলো মাথায়
একটা বেসবল টুপি পরা যাতে হলুদ রঙের একটা স্টিকার রয়েছে। ববি ওদের কাছে দৌড়ে গেল, “এখানে কি কোনও
ডাক্তার আছে?” লোকটা ওকে জিজ্ঞেস করল।
“আমি ডক্টর কার্টার,” ও বলল। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা ওর
কাঁধ আর মাথায় আঘাত করার মতো করে ঝরে পড়ছে। লালচুলো লোকটা ওর দিকে একটু ভ্রূকুটি করে তাকাল। ববি একটা কাট-অফ জিনস্
(Cut-off Jeans) আর ট্যাঙ্ক টপ (Tank Top) পরে আছে। ওর গলা থেকে একটা
স্টেথোস্কোপ ঝুলছে, যার বেল*-টায় এর মধ্যেই
এখানকার নোনা হাওয়ায় জং ধরে গেছে। *[Bell—স্টেথোস্কোপের
যে অংশটি শরীরে ঠেকানো হয়]
“এড রেগিস। আমাদের একটা লোক খুবই আহত হয়েছে, ডক্টর।”
“তাহলে সবচেয়ে ভাল হয় যদি
আপনি ওঁকে স্যান জোস-এ (San Jos) নিয়ে যান,” ও বলল। স্যান জোস, এখানকার
রাজধানী, এখান থেকে হেলিকপ্টার করে গেলে মাত্র মিনিট কুড়ির রাস্তা।
“আমরা তাই যেতাম, কিন্তু এই
ওয়েদারের মধ্যে ওই পাহাড়গুলো পেরিয়ে যাওয়া যাবে না। এখানেই আপনাকে ওর চিকিৎসা
করতে হবে।”
ববি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আহত
লোকটার পাশে গেল। একটা
বাচ্চা ছেলে, আঠেরোর বেশি বয়স হবে না। ও ছেলেটার রক্তে ভেজা জামাটা তুলে দেখল একটা বড় ফালাফালা করা দাগ
ছেলেটার কাঁধটাকে পুরো চিরে দিয়েছে, ওরকমই একটা দাগ পায়েও রয়েছে।
“কী হয়েছে ওর?”
“কনস্ট্র্যাকশন অ্যাক্সিডেন্ট,” এড চেঁচিয়ে বলল। “পড়ে গিয়েছিল। ওর ওপর ব্যাকহো*-র কোপ পড়েছে।” *[Backhoe—মাটি খোঁড়ার বড় মেশিন বা গাড়ি; সাধারণত আমরা এটিকে
বুলডোজার নামে চিনি]
ছেলেটা অচেতন হয়ে রয়েছে, মুখটা বিবর্ণ
হয়ে গিয়েছে, ওর সারা দেহটা থরথর করে কাঁপছে।
ম্যানুয়েল ক্লিনিকের উজ্জ্বল
সবুজ রঙের দরজাটার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল। কালো লোকগুলো দেহটা নিয়ে এসে ঘরের মাঝখানের টেবিলটার উপরে
শুইয়ে দিল। ম্যানুয়েল
একটা ইন্ট্রাভেনাস* লাইন শুরু করে দিল, ববি লাইটটাকে ছেলেটার শরীরের উপরে ফেলে ওর
ক্ষতস্থানগুলোকে পরীক্ষা করতে লাগল। ক্ষতস্থানগুলোকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলোকে ওর খুব একটা ভাল
বলে মনে হল না।
এই ছেলেটা প্রায় নিশ্চিত ভাবে মরেই যাবে। *[Intravenous—শিরার মধ্যে দিয়ে চালিত]
একটা বড় কাটা দাগ ছেলেটার
কাঁধ থেকে শরীরের মাঝ বরাবর চলে গেছে। ক্ষতের শেষপ্রান্তের মাংস পুরো কাপড় ছেড়ার মতো ফালাফালা হয়ে
গেছে। মাঝখানে কাঁধটা পুরো
সরে গিয়েছে, হাড় বেরিয়ে এসেছে। আরেকটা গভীর ক্ষত যেটা থাইয়ের যেখানে বেশি মাংস থাকে সেখান থেকে
এমন ভাবে চিরে গেছে যে, থাইয়ের নীচের ধমনীর পালস্ যথেষ্ট স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া
যাচ্ছে। ববি
প্রথমে ওকে দেখে ভেবেছিল ছেলেটার পা বুঝি কেটেই গেছে।
“আমাকে আবার এই আঘাতগুলোর
ব্যাপারে বলুন,” ববি বলল।
“আমি দেখিনি,” এড বলল। “ওরা বলছে যে মাটি
খোঁড়ার বড় মেশিনটায় ওর এরকমটা হয়েছে।”
“কারণ এটা দেখে প্রায় মনে
হচ্ছে যে ওকে ভারী কিছু দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে,” ববি ক্ষতটাকে পরীক্ষা করতে করতে
বলল। অন্য
অনেক এমার্জেন্সি রুম ফিজিশিয়ানদের মতোই, ও ভাল করেই এত বছরে ওর দেখা রুগীদের
পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মনে করতে পারছিল। ও এর আগে দু’টো ক্ষতবিক্ষত
হওয়া বডি দেখেছিল। প্রথমটা ছিল দু’বছর বয়সি একটি বাচ্চা যাকে একটা রটউইলার (Rottweiler)
কুকুর কামড়েছিল। আরেকজন ছিল সার্কাসে কাজ করা এক মাতাল যাকে একটা বেঙ্গল
টাইগার আক্রমণ করেছিল। ওই দু’জনের আঘাতের ধরন একই রকম ছিল। দু’টো আঘাতই দেখে
মনে হয়েছিল যে, এগুলো জানোয়ারের আক্রমণের ফলেই হয়েছে।
“বাড়ি মারা?” এড বলল। “না, না। ওটা মাটি খোঁড়ার
মেশিনই ছিল, বিশ্বাস করুন।” এড কথা বলার সময় ওর ঠোঁট চাটছিল। খিটখিট করছিল, এমন করছিল
যেন ও কিছু খারাপ কাজ করে ফেলেছে। ববি ভেবে পাচ্ছিল না ওর এরকম করার কারণটা কী। ওরা যদি রিসর্ট কনস্ট্র্যাকশনে
অনভিজ্ঞ স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়েই কাজ করাতে থাকে, তাহলে তো সব সময়ই দুর্ঘটনা ঘটবে।
ম্যানুয়েল বলল, “তুমি কি
ক্ষতগুলোকে পরিষ্কার করতে চাও?”
“হ্যাঁ,” ববি বলল। “তোমার সেলাই করবার
পর।”
ববি নীচের দিকে ঝুকে পড়ে
আঙুলের ডগা দিয়ে ক্ষতগুলোকে পরীক্ষা করতে লাগল। যদি একটা মাটি কাটার মেশিনই
ওর এই অবস্থা করে থাকে, তাহলে ক্ষতগুলোর ভিতরে মাটি ঢুকে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোথাও কোনও
মাটি নেই, শুধুমাত্র অল্প একটু পিচ্ছিল ফেনা লেগে রয়েছে। আর ক্ষতগুলো থেকে একটা
অদ্ভুত গন্ধ আসছে, একটা বিশ্রী পচা দুর্গন্ধ, মড়া পচা গন্ধ
যেরকম হয় সেরকম গন্ধ। ও এর আগে এরকম গন্ধ কখনও শোঁকেনি।