জুরাসিক পার্ক – মাইকেল ক্রিকটন (বাংলা অনুবাদ; পর্ব ৩)
যেটি আজকের দিনে বিখ্যাত হয়ে
ওঠা একটি মিটিং-এর সময়। যে মিটিং-এ ছিলেন রবার্ট স্যানসন, যিনি এক জন ভেঞ্চার
ক্যাপিটালিস্ট১, এসেছিলেন হারবার্ট বোয়ার, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার এক জন বায়োকেমিস্ট২। ওই দু’জন বোয়ারের
জিন-স্প্লিসিং টেকনিক৩-কে কাজে লাগাতে একটি
কমার্শিয়াল কোম্পানি খোলার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। তাঁদের নতুন কোম্পানি, জেনেনটেক (Genentech), খুব তাড়াতাড়িই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উপরে কাজ করা নতুন কোম্পানিগুলোর
মধ্যে সব চেয়ে বড় আর সব চেয়ে সফল হয়ে উঠেছিল। [১Venture capitalist—যে পুঁজিপতি ঝুঁকি
নিতে ভয় পায় না, ২Biochemist—জীব রসায়নবিদ, ৩Gene-splicing
technique—জিনের গঠন দড়ির মতো প্যাঁচালো করার পদ্ধতি]
হঠাৎই দেখা গেল যে, সবাই বড়লোক
হতে চাইছে। প্রায়
প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন কোম্পানি খোলার কথা ঘোষণা হতে লাগল, আর এই
সুযোগটাই আমাদের বিজ্ঞানী বন্ধুরা জেনেটিক রিসার্চ করতে কাজে লাগালেন। ১৯৮৬ সালের মধ্যে, ন্যাশনাল
অ্যাকাডেমির ৬৪ জন বিজ্ঞানীদের ধরে অন্তত ৩৬২ জন বিজ্ঞানী, বায়োটেক
ফার্মগুলির অ্যাডভাইসরি* বোর্ডগুলির পদাধিকারী হলেন। এই সংখ্যাটা হল
তাঁদের, যারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মহান মহান সব নিরপেক্ষ অবস্থান বা পরামর্শ বজায়
রেখেছিলেন।
*[Advisory—উপদেষ্টা]
এটা খুবই জোর দিয়ে বলা দরকার যে, এই পরিবর্তনের
উচ্চতাটা কতটা অর্থপূর্ণ ছিল। অতীতে, প্রকৃত বিজ্ঞানীরা ব্যবসা জিনিসটাকে এমন
নজরে দেখতেন যার একটাই মানে হয়, ‘ব্যবসা গরিবকে অবজ্ঞা করে
এবং বড়লোকের পা চাটে।’ তাঁরা টাকার পিছনে ছোটার নেশাটাকে এক মনিষীসুলভ অনাগ্রহের
চোখে দেখতেন, মনে করতেন এ জিনিসটা শুধুমাত্র দোকানদারদেরই মানায়। আর এমনকী প্রবঞ্চনাতে
ভর্তি বেল (Bell) বা আইবিএম (IBM) ল্যাবে
ইন্ডাস্ট্রির জন্য যে গবেষণা করতেন, সেগুলো শুধুমাত্র তাদের জন্য, যারা ইউনিভার্সিটির অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেত না। এই রকম ভাবে প্রকৃত
বিজ্ঞানীদের উচ্চতা ভিত্তিগত ভাবে ব্যবহারিক বিজ্ঞানীদের থেকে একটু সমালোচনাকরই
ছিল, এবং অবশ্যই ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা খাটে। তাদের দীর্ঘকালীন
বিরোধিতা ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের ইন্ডাস্ট্রির বেড়াজালের দূষণ থেকে দূরে সরিয়ে
রাখত। আর যখনই টেকনোলজিক্যাল* ব্যাপারস্যাপার নিয়ে
বিতর্ক উঠত, নিরপেক্ষ স্বার্থহীন বিজ্ঞানীদের সেই সমস্যা নিয়ে উচ্চস্তরে আলোচনা করার জন্য
সব সময় দেখতে পাওয়া যেত। *[Technological—প্রযুক্তিগত]
কিন্তু এই কথাটা আজকের দিনে
আর সত্যি হয়ে নেই। আজকের
দিনে খুবই অল্প সংখ্যক গবেষক আর কিছু মলিকিউলার বায়োলজিস্ট* রয়েছেন যাদের
বাণিজ্যিক আসক্তি নেই। পুরনো দিন চলে গিয়েছে। জেনেটিক রিসার্চ এখনও চলছে, আগের থেকে
আরও প্রচণ্ড গতিতে চলছে। কিন্তু সেটা হচ্ছে খুবই গোপনীয় ভাবে, তাড়াহুড়ো করে, আর করা হচ্ছে ব্যবসায়িক লাভের কথা ভেবে। *[Molecular biologist—আণবিক জীববিদ]
এই বাণিজ্যিক আবহাওয়ার মধ্যে, সম্ভবত এটা
বাদ দেওয়া যায় না যে, একটা কোম্পানি পালো আল্টো-র (Palo Alto)
ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিক টেকনোলজিস্ ইনকর্পোরেটেড-এর মতোই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হবে, বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সাথে সাথে এটাও খুব অবাক করার মতো খবর হবে না এর ফলে যে
জেনেটিক ক্রাইসিস* তৈরি হচ্ছে সেটা কিন্তু কোথাও রিপোর্ট করা হয় না। যত দূর জানা যায়, ইনজেনের
গবেষণাও বেশ গোপনীয় ভাবেই হয়েছিল; আসল ঘটনাটা মধ্য আমেরিকার একেবারে একটি অজ
পাড়াগাঁয়ের মতো জায়গায় ঘটেছিল; আর সেখানে খুব বেশি হলে জনা কুড়ি লোক ছিল
যারা চোখের সামনে ব্যাপারটা ঘটতে দেখেছিল। অবশ্য তাদের মধ্যে, হাতেগোনা কয়েক
জনই মাত্র বাঁচতে পেরেছিল। *[Genetic crisis—সৃষ্টি সংকট]
এমনকী একদম শেষে, যখন
ইন্টারন্যাশনাল জেনেটিক টেকনোলজিস্ ১৯৮৯ সালের ৫ই অক্টোবর স্যান ফ্রান্সিস্কোর
সুপেরিয়র কোর্টে চ্যাপ্টার ১১-য় নিরাপত্তার জন্য কেস দাখিল করল, সেখানে চোখে পড়ার মতো সংবাদমাধ্যমের কম উপস্থিতি ছিল। ব্যাপারটা যেন খুবই
সাধারণ একটা ঘটনা এ রকম ভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল: ইনজেন সেই বছরের আমেরিকার তিন
নম্বর
স্বল্পমেয়াদি বায়োইঞ্জিনিয়ারিং
কোম্পানি ছিল যেটি আগের অন্য আরও দু’টি কোম্পানির মতো মুখ থুবড়ে পড়ে, আর তৈরি হওয়া থেকে ধরলে অর্থাৎ ১৯৮৬ থেকে ধরলে সাত নম্বর। সেই সময় কোর্টের অনেক
ডকুমেন্ট-ই জনসমক্ষে চলে আসছিল, যে রকম ক্রেডিটর১-রা হল জাপানি ইনভেস্টমেন্ট কন্সোরিটা২, যে রকম হামাগুরি
আর ডেনসাকা, এমন এমন কোম্পানি যারা প্রথাগত ভাবে পাবলিসিটি এড়িয়ে চলে। অপ্রয়োজনীয় সত্য
প্রকাশ হয়ে যাওয়া আটকাতে, ‘ক্যোয়ান, স্যওয়েন অ্যান্ড র্যস’-এর ড্যানিয়েল র্যস, ইনজেনের
পরামর্শদাতা, জাপানি ইনভেস্টরদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করত। আর কোস্টা রিকা-র (Costa Rica) ভাইস কন্সাল৩-এর কিছু মাত্রায় করা
অস্বাভাবিক আবেদন-নিবেদন বন্ধ দরজার পেছনেই শোনা হয়েছিল। এই রকম ভাবে এটাও খুব
আশ্চর্যের কিছু বলে মনে হয়নি, যখন এক মাসের মধ্যেই,
ইনজেনের সমস্যাগুলোর চুপচাপ ভাবে আর আপস করে মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। [১Creditor—যারা টাকা ধার দেয়, ২Consorita—এমন একটি
ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি যাদের একসাথে অনেক ধরনের ব্যবসা থাকে, ৩Vice consul—সহকারী বাণিজ্যদূত]
এই মীমাংসায় থাকা বাদী-বিবাদী
দুই পক্ষই, যাদের মধ্যে অ্যাডভাইসরদের বিশিষ্ট সায়েন্টিফিক বোর্ডও ছিল, একটি গোপন এগ্রিমেন্টে
সই করেছিল। আর তার সাথে এই
প্রতিজ্ঞাও করা হয়েছিল যে, কী ঘটেছিল সে ব্যাপারে বাইরের লোকের কাছে কেউ মুখ খুলবে না। কিন্তু শোনা যাচ্ছে “ইনজেন-এর
ঘটনা”-র সাক্ষী থাকা অনেক লোকই ওই চুক্তিপত্রটায় সই করেনি, আর তারা কোস্টা
রিকা-র পশ্চিম উপকূল থেকে বহু দূরের একটি দ্বীপে ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের সেই দু’দিনের অসাধারণ
ঘটনাটির কথা জনসমক্ষে আনতে চায় বলে জানা গেছে।
No comments:
Post a Comment